গুপ্ত সাম্রাজ্য
গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা: শ্রীগুপ্ত এবং তার পুত্র ঘটোৎকচগুপ্ত মহারাজা’ উপাধি ধারণ করেন।
শ্রীগুপ্তের শাসনকাল হল ২৭৫-৩০০ এবং ঘটোৎকচগুপ্তের শাসনকাল ৩০০-৩২০ খ্রিঃ। গুপ্ত মুদ্রায় ‘কচ’ নামের উল্লেখ রয়েছে। ঘটোৎকচ নামের অপভ্রংশ হল ‘কচ’। গুপ্ত বংশের তৃতীয় রাজা ছিল প্রথম চন্দ্রগুপ্ত।প্রথম চন্দ্রগুপ্ত লিচ্ছবি কন্যা কুমারদেবীকে বিবাহ করেন। প্রথম চন্দ্রগুপ্তের
সময় মগধের রাজা ছিলেন সুন্দরবর্মন। প্রথমচন্দ্র গুপ্তের শাসনকাল হল ৩২০-৩৩৫ খ্রিষ্টাব্দ।
প্রথম চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে ২৬ শে ফেব্রুয়ারি ৩২০ খ্রিস্টাব্দ (৩১৯-৩২০ খ্রিস্টাব্দ) থেকে নতুন বর্ষ গণনা শুরু হয় ,যার নাম গুপ্তাব্দ।
সমুদ্রগুপ্ত: প্রথম চন্দ্রগুপ্তের পাটরানি কুমারদেবীর গর্ভে সমুদ্রগুপ্তেরজন্ম হয়। এলাহাবাদ প্রশস্তির (হরিষেণের লেখা) চতুর্থ স্তবক থেকে জানা যায় যে, যােগ্য বিবেচনা করে চন্দ্রগুপ্ত রাজসভায় যখন তাকে উত্তরাধিকারী ঘােষণা করেন তখন তার তুল্য কুলশদের মুখ হতাশায় পাংশুবর্ণ হয়ে যায়। এর থেকে মনে করা হয় যে, তার কোনাে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ছিল। যার নাম সম্ভবত ‘কচ’। সমুদ্রগুপ্ত সম্পর্কে ঐতিহাসিক উপাদান হল তার সভাকবি হরিষেণ রচিত এলাহাবাদ প্রশস্তি এবং মধ্যপ্রদেশের এরণলিপি। এছাড়া গয়া ও নালন্দা লিপি থেকেও কিছু তথ্য পাওয়া যায়। এলাহাবাদ লিপি অশােকের স্তম্ভের গায়ে খােদাই করা হয়। এই লিপিটি বর্তমানে এলাহাবাদ দুর্গে রয়েছে।
»সমুদ্রগুপ্তের রাজ্যজয় সম্পর্কে হরিষেণ রচিত এলাহাবাদ প্রশস্তি থেকে জানা যায়—এলাহাবাদ প্রশস্তির ১৯২০ নম্বর পংক্তিতে সমুদ্রগুপ্তের দক্ষিণভারত বিজয়ের কথা রয়েছে। তিনি দক্ষিণের ১২ জন রাজাকে পরাস্ত করেন। সমুদ্রগুপ্ত দাক্ষিণাত্য জয় করলেও রাজ্যগুলিকে অধিগ্রহণ না করে তিনি গ্রহণ পরিমােক্ষ’ নীতি গ্রহণ করেন। এই নীতিকে ‘ধর্মবিজয়’ নীতিও বলা হয়। এই বারাে জন রাজ্য ও রাজার নাম হল (১) কোশলরাজ মহেন্দ্র (2) মহাকান্তারের ব্যাঘ্ররাজ (৩) কৌরলের মন্তরাজ (৪) পৃষ্ঠপুরমের মহেন্দ্রগিরি (৫) কুট্টরের স্বামীদত্ত (৬) এরন্তপল্লের দমন (৭) কাঞ্চির বিষ্ণুগােপ (৮) বেঙ্গির হস্তিবর্ম। (৯)অবমুক্তার নীলরাজ (১০) পলার্কের উগ্রসেন (১১) দেবরাষ্ট্রের কুবের(১২) কুস্থলপুরের ধনঞ্জয়। এলাহাবাদ প্রশক্তির সপ্তম স্তবকে ১৩ থেকে ১৪ পংক্তিতে লেখা আছে তিনি আর্যাবর্তের আটজন রাজাকে পরাজিত করেন। এই আটজন রাজা (মতান্তরে নয়জন) হলেন অহিছত্রের অচ্যুত, পদ্মাবতী বা গােয়ালিয়রের নাগসেন, মথুরার গণপতিনাগ, বাকাটকরাজ রুদ্রদেব, বুলন্দশরের মত্তিল, নাগদত্ত, নন্দীবর্মণ, বলবর্মণ ও চন্দ্রবর্মণ। সমুদ্রগুপ্ত আটবিক রাজ্য জয় করেন। উত্তরপ্রদেশ থেকে মধ্যপ্রদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত অরণ্যঅঞ্চল গাজীপুর ও জব্বলপুর জেলা নিয়ে এই রাজ্য বিস্তৃত ছিল। এছাড়া তিনি সমতট (পূর্ববঙ্গ), দাভক (আসাম), কামরূপ (আসাম), নেপাল, কর্তীপুর (কাশ্মীর) এবং নটি উপজাতি প্রজাতান্ত্রিক রাজ্য জয় করেন। ঐ নটি রাজ্য হল (১) মালব (রাজস্থান) (২) অর্জুনায়ন (জয়পুর) (৩) যৌধেয় (পাঞ্জাবের শতদ্রু বিপাশা অঞ্চল) (৪) মদ্রক (পাঞ্জাবের রাভী), (৫) আভীর (মধ্যপ্রদেশের ভালসা) (৬) প্রার্জুন (গান্ধার),
(৭) সন্ধানিক (মধ্যপ্রদেশের ভিলসার নিকট) (৮) কাক (কাশ্মীর)(৯) খপরীক (মধ্যপ্রদেশের দামাে জেলা)। সমুদ্রগুপ্তের রাজ্যসীমার বাইরে প্রতিবেশীরা তাঁর পরাক্রম অনুভব করে তার সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করে দূত পাঠান। সিংহলের রাজা মেঘবর্ণ, কুশান দৈবপুত্রশাহী, শকমুরন্ড, শাহানুশাহী প্রমুখ তার মিত্রতা ভিক্ষা করেন।সমুদ্রগুপ্তের রাজত্বকাল হল ৩৩৫-৩৮০ খ্রিস্টাব্দ। তিনি অশ্বমেধ যজ্ঞ করেন। তিনি শিল্প, সাহিত্য, সংগীত ইত্যাদির প্রতি অনুরাগী ছিলেন । তার বীণা বাদনরত মূর্তিযুক্ত মুদ্রা তার সংগীতপ্রিয়তার সাক্ষ্য বহন করেছে ।সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ প্রশস্তি থেকে জানা যায় যে, ১০০টিযুদ্ধে জয়লাভের জন্য তাকে বলা হয় শত যুদ্ধের নায়ক। ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ তাকে ভারতের নেপােলিয়ান’ বলে অভিহিত করেছে। সমুদ্রগুপ্তের মন্ত্রী ছিলেন বিখ্যাত বৌদ্ধ পণ্ডিত বসুবন্ধু।
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত : সমুদ্রগুপ্তের মৃত্যুর পর তার পুত্র দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত সিংহাসনে বসেন।এরণ লিপি থেকে এটা জানা যায়। তার মায়ের নাম ছিল দত্তাদেবী। বিশাখদত্তের ‘দেবীচন্দ্রগুপ্ত’ নাটক থেকে জানা যায় যে, সমুদ্রগুপ্তের পর তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র রামগুপ্ত সিংহাসনে বসেন। তিনি শক রাজা বসনের
কাছে পরাস্ত হয়ে তার রানি ধ্রুবদেবীকে তার হাতে তুলে দেন। রানির সম্মানার্থে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত শক রাজাকে হত্যা করেন। এছাড়া রামগুপ্তকে হত্যা করে ধ্রুবদেবীকে বিবাহ করেন। এই ঘটনার উপর আলােকপাত করেছে বাণভট্টের ‘হর্ষচরিত এবং রাজশেখরের কাব্যমীমাংসা’। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত নাগবংশীয় রাজকন্যা কুবেরনাগাকে বিবাহ করেন। কুবেরনাগার গর্ভজাত কন্যা প্রভাবতী গুপ্তাকে তিনি বাকাটক রাজা দ্বিতীয় রুদ্রসেনের সঙ্গে বিবাহ দেন। কদম্বলিপি থেকে জানা যায় যে কদম্ববংশের কাকুৎসুবর্মণের কন্যাকে নিজপুত্র কুমারগুপ্তের সঙ্গে বিবাহ দেন। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত শকদের পরাস্ত করেন। শকরাজা তৃতীয় রুদ্রসেনকে তিনি পরাস্ত ও হত্যা করেন। তিনি শকদের দমন করে শকারি উপাধি গ্রহণ করেন। তিনি তার রাজধানী উজ্জয়িনীতে নিয়ে যান। তিনি বাংলায় অভিযান চালান। সিন্ধুনদ পর্যন্ত হয়ে রােহিলা রাজ্য জয় করেন। দিল্লির মেহরােলিতে লােহার থামে যে চন্দ্রের নাম আছে ঐতিহাসিকরা তাকে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বলে অভিহিত করেছেন। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রীর নাম ছিল বীরসেন। সনকানিক মহারাজার একটি ভূমিদানপত্র উদয়গিরিতে পাওয়া গেছে। সাঁচির সেনাপতি অমর কাদের হলেন দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সামন্ত। তিনি রূপা এবং তামার মুদ্রা প্রচলন করেন। স্বর্ণমুদ্রাকে বলা হত দিনার। তার মুদ্রায় জায়গায় চৈত্য গরুড় এবং রূপ কৃতি (অর্ধচন্দ্র ও তারকা) খােদাই করেন। তার সময়ে বিখ্যাত চৈনিক পর্যটক ফা-হিয়েন ভারত ভ্রমণে আসেন এবং ভারতবর্ষ পরিদর্শন করেন ৩৯৯–৪১৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। তার রাজসভায় ছিল নবরত্ন—এঁরা হলেন কালিদাস, রাহমিহির, আর্যভট্ট, খুপনখ, ধন্বন্তরী, অমরসিংহ, শঙ্কু, বররুচি ও বেতালভট্ট। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সময়ে মল্লিনাথ এবং দিগচার্য ছিলেন বিখ্যাত
টিকাকার এবং ধর্মশাস্ত্রের ভাষ্যকার। তিনি ‘বিক্রমাদিত্য’ উপাধি নেন। এবং তাঁর রাজধানী ছিল উজ্জয়িনী এবং পাটলিপুত্র। ফা-হিয়েনের লেখা ভারতভ্রমণ সংক্রান্ত গ্রন্থের নাম হল ফু-কুয়াে-কিং।
কুমারগুপ্তঃ দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের পর তার পুত্র প্রথম কুমারগুপ্ত সিংহাসনে বসেন।
তিনি ৪০ বছর রাজত্ব করেন। তাঁর রাজত্বকাল হল ৪১৫-৪৫৪ খ্রিস্টাব্দে। তিনি অশ্বমেধ যজ্ঞ করেন। তার মায়ের নাম ছিল ধ্রুবদেবী। প্রথম কুমারগুপ্ত আমেদাবাদ, বলভি, জুনাগড়, মরভি সাঁতারা এবং বেরার তার সাম্রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত করেন। তিনি দেবতা কার্তিকের ভক্ত ছিলেন
এবং পরে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। নর্মদার মেকলা অঞ্চলে পুষ্যমিত্র তার রাজ্য আক্রমণ করেন। তার সময়ে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে। প্রথম কুমারগুপ্ত হূণ আক্রমণ থেকে তার রাজ্যকে রক্ষা করেন এবং ‘মহেন্দ্রাদিত্য’ উপাধি নেন। তার সময়ে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে লেখ উৎকীর্ণ করা হয়।
স্কন্দগুপ্ত : প্রথম কুমারগুপ্তের পর স্কন্দগুপ্ত সিংহাসনে বসেন। স্কন্দগুপ্ত দ্বারা খােদিত ভিটারি স্তম্ভলিপি থেকে তার সম্পর্কে জানা যায়। এছাড়া সোমদেব ভট্টের কথাসরিতসাগর থেকে তার সম্পর্কে জানা যায়। তিনি হ্ণদের পরাস্ত করেন। তার উপাধি ছিল ‘ক্রমাদিত্য। তার রাজত্বকাল
৪৫৪-৪৬৭ খ্রিস্টাব্দে। প্রথম কুমারগুপ্তের প্রধানামহিষী ছিলেন অনন্তদেবী এবং তাঁর পুত্র ছিলেন পুরুগুপ্ত। পুরুগুপ্তের সঙ্গে স্কন্দগুপ্তের যুদ্ধ হয়। জুনাগড় পাহাড় লিপিতে বলা হয়েছে লক্ষ্মী স্বেচ্ছায় স্কন্দগুপ্তকে ত্যাগ করে অন্য রাজপুত্রদের বরণ করেন। তার সময় ভারতবর্ষে যে হুণরা আক্রমণ করে তারা ছিল অ্যাপপার্থালাইট বা শ্বেত হূণ (Ephthalite)। তিনি হূণআক্রমণ প্রতিহত করেন বলে ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার তাকে ভারতের রক্ষাকারী’বলেছেন। সৌরাষ্ট্রের সুদর্শন বাঁধ ঝড়ে ভেঙে গেলে তার কর্মচারী পরাণদত্ত এবং তার পুত্র চক্রপালিত বাঁধটি মেরামত করেন বলে জুনাগড় লিপি থেকে জানা যায়। তাঁর কর্মচারী ও সেনাপতিদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন দোয়াবের সর্বনাগ, সৌরাষ্ট্রের পরাণদত্ত, কোশাম্বীর ভীমদত্ত। ৪৬৭ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যু হয়।