Advertisements
সিন্ধু সভ্যতা
কোনাে কোনাে ঐতিহাসিকের মতে সিন্ধু সভ্যতা ছিল তাম্র যুগের সভ্যতা অবার কোনাে কোনাে ঐতিহাসিকের মতে এই সভ্যতা ছিল ব্রোঞ্জ যুগের সভ্যতা। মেসােপটেমিয়া ও মিশরের চেয়েও বড়াে ছিল এই সিন্ধু সভ্যতা। এটি বিস্তৃত ছিল ১৩ লক্ষ বর্গ কিলােমিটার। এই সভ্যতায়, ২৫০টি কেন্দ্র আবিষ্কৃত হয়েছে এবং ২৮০০টি স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদরাে শহর দুটি সিন্ধু অববাহিকায় অবস্থিত বলে প্রথম দিকে এই সভ্যতাকে ‘সিন্ধু সভ্যতা’ বলা হত। কিন্তু পরে সিন্ধু উপত্যকার বাইরে নানা স্থান থেকে এই সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কৃত হওয়ায় এই সভ্যতার ব্যাপক বিস্তৃতির পরিপ্রেক্ষিতে এখন একে আর ‘সিন্ধু সভ্যতা’ না বলে প্রথম আবিষ্কৃত কেন্দ্র হরপ্পার নাম অনুসারে একে ‘হরপ্পা সভ্যতা’ বলা হয়। এছাড়া মহেঞ্জোদরাের তুলনায় হরপ্পায় অধিকতর গ্রামীণ প্রত্নসামগ্রী আবিষ্কৃত হয়েছে এবং মহেঞ্জোদরাের চেয়ে তা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এইসব কারণে প্রত্নতত্ত্ববিদগণের কাছে এই সভ্যতা ‘হরপ্পা সভ্যতা’ নামে পরিচিত হয়েছে।
♦সময়কাল:
জন মার্শালের মতে সিন্ধু সভ্যতার সময়কাল হল ৩২৫০ থেকে ২৭৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। সিন্ধু সভ্যতায় প্রাপ্ত শিলমােহর থেকে অনুমান করা হয় সিন্ধু সভ্যতার সময়কাল হল ২৩৫০ থেকে ১৭৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। অধিকাংশ ঐতিহাসিকরা মনে করেন সিন্ধু সভ্যতার প্রকৃত সময়সীমা হল ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।
১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে ওয়াল্টার ফায়ার সার্ভিস কোয়েট্টা উপত্যকা খনন করে প্রাপ্ত শিলমােহর থেকে প্রমাণ করেন সিন্ধু সভ্যতার সময়সীমা ২০০০ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে ঐতিহাসিক ডি পি আগরওয়াল বলেন যে সিন্ধু সভ্যতার সময়সীমা হল ২৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১৭৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। হুইলার, সি জে গ্যাড এবং ব্যাসামের মতে ২৫০০ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বের মধ্যে।
+সিন্ধু সভ্যতায় আবিষ্কৃত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান:
♦ হরপ্পা: সিন্ধু সভ্যতার প্রথম আবিষ্কৃত স্থানটি হল হরপ্পা। হরপ্পাপাঞ্জাবের মন্টোগােমারী জেলায় রাভি নদীর তীরে অবস্থিত। ১৯২১খ্রিস্টাব্দে দয়ারাম সাহানি হরপ্পা আবিষ্কার করেন। এর পরে সিন্ধু সভ্যতার নাম হল হরপ্পা সভ্যতা। হরপ্পা প্রথমে পর্যবেক্ষণ করেন ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে ম্যাসন। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে এম এস ভেটস খনন কার্য চালান।
বার ইউনিট শস্যাগার, কফিন সমাধি, তামার ইক্কা, তলােয়ার, পাথরের নর্তকী মূর্তি, লিঙ্গ, যােনি এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম শিলমােহর পাওয়া গেছে। হরপ্পা ছিল প্রধান নৌকা তৈরির কেন্দ্র। হরপ্পার চারদিক ছিল সিটাডেল দ্বারা পরিবেষ্টিত।
♦মহেঞ্জোদরাে: সিন্ধু সভ্যতার বৃহত্তম কেন্দ্র হল মহেঞ্জোদরাে। লাহােরের লারকানা অঞ্চলে সিন্ধ নদীর তীরে এটি অবস্থিত। মহেঞ্জোদরাে কথার অর্থ হল ‘মৃতের স্তুপ। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে এই সভ্যতা আবিষ্কার করেন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। এর জনসংখ্যা ছিল ৪১ থেকে ৪৫ হাজারের মধ্যে।
♥লােথাল: লােথাল বিশ্বের প্রাচীনতম পােতাশ্রয়। লােথাল অবস্থিত ছিল বর্তমান গুজরাটের আমেদাবাদ অঞ্চলের সারাঙ্গা জেলায়। আর রাও লােথাল আবিষ্কার করেন। এর চারদিক উঁচু প্রাচীর ছিল মূলত বন্যা।প্রতিরােধের জন্য।১৮০০খ্রিস্টপূর্বাব্দে এখানে, প্রথম ধানের চাষ হয়।লােথাল মূলত শেলের অলঙ্কার এবং পুঁথির অলঙ্কারের জন্য প্রসিদ্ধ।এখানে আগুনের বেদী, টেরাকোটার ঘােড়া, পার্শিয়ান শিলমােহর, তুষ, মাছ ও পাখি চিত্রিত বাসনপত্র, হরপ্পার শিলমােহর, জোড়া কবর এবংকাপড়ের টুকরাে পাওয়া গেছে।
কালিবঙ্গান: কালিবঙ্গান ছিল বর্তমান রাজস্থানের গঙ্গানগরের হনুমানগড়ে। কালিবঙ্গান আবিষ্কার করেন এ ঘােষ। এখানে আয়তাকার, কবর, আইভরি নির্মিত চিরুনি, আমার বালা, কাঠের ঠেলাগাড়ি, কাঠের লাঙল, লিঙ্গ ও যােনি এবং’তামার ষাঁড় পাওয়া গেছে।
এছাড়া চানদারাে,সুক্তাজেন্দোর, বনওয়ালি, রংপুর, সুরকোল্ডা, কোদিজি, রােপার,আলমগীরপুর, আলমুরাদ, বােলাভীরা, বালাকোট, দেশালপুর, আলহাদিনাে এবং রাখিগ্রহী ইত্যাদি।
♦সমাজজীবন:
সমাজ সংগঠন ও শ্রেণি বৈষম্য: সিন্ধু সংস্কৃতির নগরগুলিতে সমাজে শ্রেণি বৈষম্য ছিল ইতিহাসবিদ দামােদর ধর্মানন্দ কোশাম্বীর মতে (১) প্রভাবশালী পুরােহিত ও
শাসকগােষ্ঠী, (২) বেতনভুক যােদ্ধা সম্প্রদায়
(৩) বণিক, কারিগর ও ভূস্বামীদের দল এবং (৪) চাষি, দরিদ্র শ্রমিক, ভৃত্য ও দাস—এই চার শ্রেণির মানুষ নিয়ে গড়ে উঠেছিল হরপ্পা সভ্যতার সমাজ। বৃহৎ প্রাসাদ,দুর্গ এবং ক্ষুদ্র দু’কামরা ঘর ধনী-দরিদ্রের শ্রেণি বৈষম্যের প্রমাণ দেয়।শুধু ছােট বড় বাড়ির তারতম্যে নয়, কবরগুলির তারতম্যেও শ্রেণিবৈষম্যের প্রমাণ পাওয়া যায়। এমনকী সিন্ধুর নগরগুলিতে ক্রীতদাসও
ছিল বলে মনে করা হয়। দু কামরার ব্যারাক ঘরে বসবাসকারী ক্রীতদাসকে গােলাঘরের কাজের জন্য নিয়ােগ করা হত।
* পৌর ব্যবস্থা: সিন্ধুর নগরগুলি বিন্যাস এবং নগর ব্যবস্থার সংগঠন লক্ষ করে ঐতিহাসিকরা অনুমান করেছেন, এই নগরগুলির পৌর ব্যবস্থা বেশ শৃঙ্খলাবদ্ধ ছিল। পৌর ব্যবস্থা মজবুত না হলে পয়ঃপ্রণালীগুলি চালু রাখা, রাস্তা-ঘাট পরিষ্কার রাখা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী বাড়ি-ঘর তৈরি করা সম্ভব হত না।
স্টুয়ার্ট পিগটের মতে, হরপ্পা সভ্যতা যেরূপ বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিয়ে ছিল, তার পরিচালনার জন্য হরপ্পা ও মহেঞ্জোদরােতে দুটি রাজধানী বা শাসনকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। তবে রাজা বা শাসক হয়তএকজনই ছিল তার কারণ দুটি শহরের একই প্রকার পরিকল্পনা ও পরিচালনার প্রণালী দেখা যায়। মহেঞ্জোদরাে ও হরপ্পার শেষের দিকে এই পৌর ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। মহেঞ্জোদরােতে শহরের ৯টি স্তর পাওয়া যায়।
* জীবিকা: সিন্ধুর অধিবাসীদের জীবিকা ছিল কৃষি, শিল্প এবং বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল। যে সভ্যতা মহেঞ্জোদরাে ও হরপ্পার মত সমৃদ্ধ শহর সৃষ্টি করেছে সেই সভ্যতার কৃষি অর্থনীতি অবশ্যই উন্নত ছিল। কৃষি অর্থনীতির বিকাশ না হলে নাগরিক সভ্যতার উদ্ভব হয় না। নগরে কৃষি উৎপাদন হয় না, সেখানে প্রধানত শিল্প ও ব্যাবসা-বাণিজ্য এবং প্রশাসনিক কাজকর্ম হয়। মহেঞ্জোদরাে ও হরপ্পার মত শহরগুলির উন্নতির মূল কারণ সিন্ধু উপত্যকায় কৃষির উন্নতি। সিন্ধু উপত্যকারজমিও ছিল কৃষির বিকাশের অনুকূল।
* খাদ্য: সিন্ধুর অধিবাসীদের খাদ্য ছিল গম, যব, ভাত, তরি-তরকারি, কড়াইশুটি, বাদাম, খেজুর প্রভৃতি। সিন্ধুর গ্রামাঞ্চলে এই খাদ্য দ্রব্যগুলাে উৎপাদন হত। সিন্ধু অঞ্চলে ধানের চাষ হত। লােথাল ও রংপুরে ধানের তুষ পাওয়া গেছে। আমিষ খাদ্য হিসাবে লােকে ভেড়ার মাংস, শুকরের মাংস, পাখির মাংস এবং মাছ প্রভৃতি খেত
* পশুপালন:
পশুপালন ছিল সিন্ধুর অধিবাসীদের অপর উল্লেখযােগ্য
জীবিকা। সিন্ধুর অধিবাসীরা ভেড়া, মহিষ ও কুঁজওয়ালা ষাঁড়, গরু, কুকুর প্রভৃতি পশুপালন করত। এছাড়া উট, বলদ, গাধা এসব পশু দিয়ে মাল বহনের কাজ করত।
পােশাক:
সিন্ধু অঞ্চলে সুতি বস্ত্রের উৎপাদন ব্যাপক থাকায় তুলার চাষ ছিল বিখ্যাত। সিন্ধুর শহরগুলিতে বস্ত্রবয়ন একটি বড় শিল্প ছিল। মহেঞ্জোদরাের বিভিন্ন বাড়ি থেকে সুতাে কাটার যন্ত্র পাওয়া গেছে। সিন্ধুর শহরগুলি থেকে সুতি বস্ত্র পশ্চিম এশিয়ায় রপ্তানি হত।মেসােপটেমিয়ার উত্মায় সিন্ধুর শিলমােহর লাগান কাপড়ের গাঁট আবিষ্কৃত হওয়ার ফলে একথা প্রমাণিত হয়। সিন্ধু অধিবাসীরা পশমের পোশাক ব্যবহার করত বলে জানা যায়। নারীরাও দুই প্রস্থ পােক ব্যবহার করত।
নারীরা নানাবিধ অলঙ্কার পরত। কানে, হাতে, গলায় এই অলঙ্কার পড়ত।সােনা, রূপা এবং দামি পাথর থেকে এই অলঙ্কার তৈরি করা হত।গহনাগুলির পালিশ ছিল খুব উৎকৃষ্ট। নারীরা নানা ছাঁচে কবরী বাঁধতএবং সুগন্ধি দ্রব্যের দ্বারা প্রসাধন করত। চোখে সুরমা লাগাত। হরপ্পা সংস্কৃতিতে বুর্জোয়া বা মধ্যবিত্ত বণিক শ্রেণির লােকেরা ফলে এই ধরনের বিলাসিতা করত। সিন্ধু অধিবাসীদের পােযাকের নিদর্শন হরপ্পায় পাওয়া একটি অতি ক্ষুদ্র মূর্তি থেকে অনুমান করা হয়। এই মূর্তির নিম্ন অঙ্গে ছিল ধুতির মত কাপড় এবং ঊর্ধ অঙ্গে ছিল একটি চাদর।
• সংস্কৃতি: সিন্ধু সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এই সংস্কৃতিরভৌগােলিক পরিমণ্ডল সুদূর বিস্তৃত ছিল। এর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এইরকমের বেশ কিছু পাথর ও ধাতুর দ্রব্যাদি পাওয়া গেছে। এ থেকেঅনুমান করা সঙ্গত যে, বিশেষ বিশেষ জিনিস বিশেষ বিশেষ কারখানায়তৈরি করা হত। পরে সেগুলি উৎপাদন স্থল থেকে বিভিন্ন নগর, শহর,গ্রামে চালান যেত। যেমন উজ্জ্বল পাথরের তৈরি ধারাল ব্লেড প্রধানত রােড়ি ও সুকুর অঞ্চলে তৈরি হত কিন্তু পরে তা অন্যত্র পাঠানাে হত। এ থেকে অনুমান করা হয় নগর পরিকল্পনার মতই কারিগরি শিল্পেরক্ষেত্রেও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ কার্যকর ছিল। হরপ্পা সংস্কৃতির শিল্পবােধ খুব উন্নত মানের ছিল না। আবাস গৃহগুলির স্থাপত্য এমনভাবে তৈরি করা হয় যার ফলে গৃহগুলিতে লােকের থাকার সুবিধা হয়। হরপ্পার ষাঁড়গুলির মূর্তি বেশ শিল্পবােধসম্পন্ন। হরপ্পায় পাখি টানা রথের খেলনা পাওয়া গেছে। এতে কিছুটা কল্পনার মিশ্রণ দেখা যায়।
+ ধর্ম বিশ্বাস:
সিন্ধু সভ্যতায় নিম্নলিখিত দেবদেবীর পূজা হত
(১) মাতৃমূর্তি: সিন্ধু সভ্যতার কেন্দ্রগুলি থেকে অসংখ্য নারীমূর্তি আবিষ্কৃত হওয়ায় ঐতিহাসিকদের অনুমান সে সময়ে এখানেমাতৃদেবীর পূজা খুব জনপ্রিয় ছিল। কোনাে কোনাে মূর্তির গায়ে ধোঁয়ারস্পষ্ট চিহ্ন দেখে মনে হয়, দেবীকে প্রসন্ন করতে আধিবাসীরা ধূপ ওপ্রদীপ জ্বালাত। শুধু তাই নয়, শিলমােহরে উৎকীর্ণ প্রতিকৃতি থেকে মনেহয় দেবদেবীর কাছ থেকে বরলাভের আশায় তারা জীবজন্তু এমনকী নরবুলিও দেওয়া হত।
(২) শিবসদৃশ দেবতার অস্তিত্ব: হরপ্পায় একটি শিলমােহরে| পশুবেষ্টিত পদ্মাসনে উপবিষ্ট, তিন মুখ ও তিনটি শিং বিশিষ্ট একটিদেবমূর্তি পাওয়া গেছে। জন মার্শাল হিন্দু দেবতা পশুপতি শিবের সঙ্গেএই দেবতার অনেক মিল খুঁজে পেয়েছেন। তবে এই দেবতারপশু বেষ্টনীতে ষাঁড় না থাকায় ব্যাসাম তাকে সরাসরি শিব না বলে আদি
শিব বলে মনে করেছেন।
(৩) লিঙ্গ ও যােনি পূজা: লিঙ্গ ও যানির আকৃতিবিশিষ্ট বেশকিছু পাথরের বস্তু এখানে আবিষ্কৃত হয়েছে, যা থেকে কোনাে কোনাে ঐতিহাসিকের অনুমান হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীরা লিঙ্গ ও যােনি পূজা করত।
(৪) দেবতা জ্ঞানে অন্যান্য বস্তুর পূজা: অন্যান্য যেসব বস্তু দেবতাজ্ঞানে পূজিত হত তার মধ্যে ছিল জল, আগুন, গাছ এবং বিভিন্ন জীবজন্তু। সম্ভবত সূর্য, স্বস্তিক চিহ্ন, চক্র চিহ্ন ইত্যাদিকে পবিত্র বলে মনে করা হত।
+ শস্যাগার:
হরপ্পায় একটি শস্যাগার আবিষ্কৃত হয়েছে। এই শস্যাগারটি হল লম্বায় ১৬৯ ফিট এবং চওড়ায় ১৩৫ ফিট (মতান্তরে ১৫০x ২০০ ফিট)। বন্যার জল যাতে এই শস্যাগারটির কোনাে ক্ষতি করতে না পারে সেজন্য পােড়ামাটির উঁচু ভিতের ওপর এই শস্যাগারটি তৈরি করা হয়। ।শস্যাগারটি কয়েকটি পৃথক পৃথক কক্ষে ভাগ করা ছিল।
শস্যাগারের পাশেই উঁচু বাঁধান চাতাল। এখানে শ্রমিকরা শস্য ঝাড়াই-মাড়াই করত।শস্যাগারের পাশেই ছিল ২ কামরা-যুক্ত শ্রমিকদের আবাসের কেন্দ্র।মােট ১৪টি ছােট ছােট দালানের একটি ব্লক লক্ষ করা যায়। কোনাে কোনাে পণ্ডিত মনে করেন যে, শ্রমিকদের এই শস্যাগারের কাজে নিযুক্ত করা হত। অধ্যাপক ব্যাসাম এই শস্যাগারটিকে রাষ্ট্রীয় ব্যাঙ্কের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি মনে করেন, এই রকম শস্যাগার মহেঞ্জোদরােতেও ছিল।
+ সভাগৃহ:
মহেঞ্জোদরােতে ৮৫x ৯৭ ফিট একটি বিরাট দালানের ভগ্নাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। চতুষ্কোণ স্তম্ভবিশিষ্ট বিরাট কক্ষযুক্ত একটি দালানের ভগ্নাবশেষও আবিষ্কৃত হয়েছে। এটিকে সভাগৃহ বলা হত।
+ স্নানাগার:
মহেঞ্জোদরােতে একটি বৃহৎ স্নানাগার আবিষ্কৃত হয়েছে। এইস্নানাগারকে সিন্ধু সভ্যতার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য বলা যায়। এইস্নানাগারের বাইরের দিকের মাপ ছিল ১৮০ x ১০৮ ফিট। স্নান করবারজলাধারটির মাপ ছিল ৩৯ X ২৩ ফিট এবং গভীরতা ৮ ফিট।জলাধারটিতে জল ঢােকাবার ও বের করবার ব্যবস্থা ছিল।
এর একপাশেবসবার জন্য মঞ্চ ছিল। জলাধারের অন্য তিন পাশে বারান্দা এবং তারপাশে ছােট ছােট ঘর ছিল। মার্টিমার হুইলারের মতে, এই স্নানাগারটি একটি ধর্মীয় উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়। পূজার্থীরা স্নান সেরে ছােট কক্ষে পােষাক পরত এবং স্নানাগার-সংলগ্ন মাতৃদেবতার মন্দিরে পুজো দিত।
+ পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা:
শিল্প নগরগুলির বাসগৃহের জল-নিকাশী ব্যবস্থা ছিল খুবই উন্নত।প্রতি বাড়ির জল বের হওয়ার জন্য পােড়ামাটির ইটের তৈরি নালী ছিল। এই নালী পথে জল নির্গত হয়ে রাস্তার পয়ঃপ্রণালীতে পড়ত।রাস্তার পাশে গর্ত করে নর্দমা তৈরি করা হত। এই নর্দমা পাথরের ঢাকনা দ্বারা চাপা দেওয়া থাকত। জলের দ্বারা বাহিত আবর্জনাকে আটকাবার জন্য মাঝে মাঝে বিশেষ ধরনের ব্যবস্থা করা ছিল। এগুলিতে নীচে নামার সিড়ি দেখে অনুমান হয় যে, এগুলি পরিষ্কার করার জন্য নাগরিক বন্দোবস্ত ছিল। নালীগুলি নিয়মিত পরিষ্কারের কিছু চিহ্ন পাওয়া গেছে।
+ অর্থনৈতিক জীবন:
* বাণিজ্য: সিন্ধু উপত্যকায় যে উন্নতি ও আরামপ্রদ নগর সভ্যতাগড়ে উঠেছিল তার মূলে ছিল বাণিজ্যিক সমৃদ্ধি। সিন্ধুর অধিবাসীদের অপর জীবিকা ছিল বাণিজ্য। এই বাণিজ্য প্রতিবেশী অঞ্চলের সঙ্গে চলত। ভারতের বাইরে পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে সুমার বা মেসােপটেমিয়ায়বেশির ভাগ বাণিজ্য চলত।
এছাড়া মিশর ও তুর্কিস্তানের সঙ্গে যথাক্রমে জলভাগে ও স্থলভাগে বাণিজ্যিক যােগ ছিল বলে মনে করা হয়। মেসােপটেমিয়ার প্রাচীন লেখ থেকে সে দেশের সঙ্গে তিনটি বিদেশি অঞ্চলের দূরপাল্লার বাণিজ্যের উল্লেখ করা হয়েছে। সেই তিনটি বিদেশি অঞ্চল হল—দিলমুন, ম্যাগান ও মেলুহা। হরপ্পার নগরগুলি থেকে হাতির দাঁতের তৈরি জিনিস, কাপড়, মণি-মুক্তা, ময়ুর, ময়ূরপুচ্ছ প্রভৃতি রপ্তানি হত। সমুদ্রপথে এই বাণিজ্য চলত।
জলপথে মিশর, সুমেরিয় এবং স্থলপথে ভারতের মহীশর, গুজরাট, কাশ্মীর, দক্ষিণের নীলগিরি পর্যন্ত সিন্ধুর শহরগুলির বাণিজ্য চলত। ব্যাবসা-বাণিজ্যে সম্ভবত বিনিময়-প্রথা প্রচলিত ছিল।
+ শিল্প ও কারিগর:
* ধাতু শিল্প:
সিন্ধুর শহরগুলিতে গৃহস্থালির যন্ত্রপাতি এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি দেখে বােঝা যায়, শহরের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ ছিল শিল্প ও কারিগর শ্রেণির লােক। পাথর দিয়ে নানা ধরনের হাতিয়ার তৈরি হত। এইসব হাতিয়ারগুলির মধ্যে উজ্জ্বল পাথরে তৈরি ধারাল বিশেষ উল্লেখযােগ্য। ধাতুর মধ্যে তামার ব্যবহার ছিল সবচেয়ে বেশি। সিন্ধুর শহরগুলিতে কোনাে লােহার তৈরি জিনিস পাওয়া যায় নি।যন্ত্রপাতিগুলি ছিল তামা বা ব্রোঞ্জের তৈরি।
রাজস্থান ও দক্ষিণ ভারত থেকে তামা আমদানি হত। দামি পাথর গুজরাট ও রাজপুতানা থেকেআনা হত। ধাতুশিল্প ও পাথর খােদাই ছিল সিন্ধু শহরের অন্যতম শিল্প।ধাতু থেকে দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য কাস্তে, কুঠার, বর্শা, তির-ধনুক,বঁড়শি, বাটখারা, সূচ, চিরুনি প্রভৃতি তৈরি করা হত। সােনা ও রূপার অলঙ্কার তৈরি করা হত।
পাথর কেটে অলঙ্কার, গলার হার তৈরি করা হত। জেড, কার্নেলিয়ন, লাপিস লাজুলি ও এ্যাগেটের মতাে দামি পাথর দিয়ে শৌখিন জিনিস ও পুঁতি তৈরি হত। পাথর দিয়ে নানা ভঙ্গিমায় মূর্তিও তৈরি হত। সিন্ধু উপত্যকায় ইট শিল্প সমৃদ্ধ ছিল। কাদামাটির ইট ও চুল্লিতে পােড়ানাে ইট দু’ধরনের ইটই তৈরি হত। সিন্ধুবাসীরা যে কাঠের চেয়ার, চৌকি ও টুল ব্যবহার করত তার প্রমাণ পাওয়া যায়।নৌকো তৈরির নিদর্শনও পাওয়া গেছে।
* মৃৎশিল্প:
সিন্ধু নগরে মৃৎশিল্পের বিশেষ বিকাশ ঘটেছিল। মাটির কলসি, জালা, থালা, বাটি ও খেলনা তৈরি হত। মৃৎশিল্পীরা পলিমাটি, বালি ও চুনের গুঁড়াে মেশানাে মণ্ড দিয়ে সরল মৃৎপাত্র তৈরি করত।তৈরি দ্রব্যগুলিকে আগুনে পুড়িয়ে মজবুত করা হত। পরে এতে রংলাগান হত। লাল পােড়ামাটির পাত্রের গায়ে কালাে রং লাগাবার বিশেষ চলন ছিল। কাচের মত চকচকে ও মসৃণ চিনামাটির পাত্র নির্মাণ হরপ্পা সংস্কৃতির মৃৎশিল্পীদের একটি উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল। এছাড়াপােড়ামাটির মূর্তি খােদাই করা থাকত।
মহেঞ্জোদরাের শিলার ওপরখােদাই করা ষাঁড়টির মূর্তি অতি প্রাণবন্ত। অনেকে মনে করেন যে,সাধারণ দরিদ্র লােকেরা জীবিকা হিসাবে পােড়ামাটির কাজকে বেছে নেয়। পােড়ামাটির তৈরি নর্তকীর মূর্তি সিন্ধু শিল্পীর দক্ষতার পরিচয় দেয়। পােড়ামাটির তৈরি নর্তকী ও মনুষ্য মূর্তিগুলি নগ্নপাত্র। তবে দেহে অলঙ্কার কম ছিল।
কিছু কিছু মূর্তিতে সামাজিক জীবনের প্রতিচ্ছবিও দেখা যায়। স্তন্যদানরত মা বা হামাগুড়ি দেওয়া শিশুর মূর্তি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। হরপ্পার মূর্তিগুলি মহেঞ্জোদরের মূর্তি অপেক্ষা পরিণত। হরপ্পায় বাঘ, গণ্ডার, পাখি, মনুষ্য মূর্তির, মাটির তৈরি আরামকেদারারখেলনা তৈরি করা হত।
+ পরিবহণ ব্যবস্থা:
সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীরা ব্যাবসা-বাণিজ্যের প্রসারের জন্য পরিবহণব্যবস্থার উন্নতির দিকে নজর দিয়েছিল। ব্যাবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত পরিবহণস্থলপথ ও জলপথে পরিচালিত হত। বহির্বাণিজ্যের বেশির ভাগই চলতসমুদ্রপথে, আরব সাগর ও পারস্য উপসাগরে উপকূলে।
লােথাল থেকে একটি পােড়ামাটির জাহাজের মডেল আবিষ্কৃত হয়েছে।মেসােপটেমিয়া তথ্যেও মেলুহা অর্থাৎ সিন্ধু উপত্যকায় সমুদ্রগামীজলযানের উল্লেখ আছে। সুতরাং বলা যায় সমুদ্রপথ বা নদীপথে জাহাজ,নৌকা চলত। দেশের ভিতর স্থলপথে ব্যাবসা-বাণিজ্যের জন্য দু’চাকাবিশিষ্ট এক্কা জাতীয় গাড়ির ব্যবহার হত। পােড়ামাটি ও ধাতুর তৈরি এধরনের গাড়ির অনেক মডেল আবিষ্কৃত হয়েছে।
For PDF→
Advertisements