1.দ্বৈতশাসন (১৭৬৫)
👉পটভূমি:
ইস্ট ইন্ডিয়া কােম্পানি দেওয়ানি লাভের পর বাংলায় একদিকে রাজস্ব আদায় এবং অপরদিকে প্রশাসনিক ও সামরিক ক্ষমতা (নিজামতি) লাভ করে। বাংলার শাসনে প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে কোম্পানি, নবাব হন নামমাত্র শাসক। একই অঞ্চলে এই দুই ধরনের শাসনকাঠামােকে দ্বৈতশাসন বলা হয়।
👉প্রবর্তনের কারণ:
দেওয়ানি লাভের পর কোম্পানি চেয়েছিল, ধীরে ধীরে বাংলার শাসনক্ষমতা বাজেয়াপ্ত করতে । রবার্ট ক্লাইভ মনে করতেন-
(১) কোম্পানি সরাসরি শাসনক্ষমতায় এলে অন্যান্য ইউরােপীয় বাণিজ্যগােষ্ঠীর মধ্যে এক তীব্র প্রতিক্রিয়া হতে পারে।
(২) প্রশাসনিক কাজ পরিচালনার জন্য প্রয়ােজনীয় সংখ্যক ব্রিটিশ কর্মচারীর অভাব রয়েছে।
(৩) ইংরেজ কর্মচারীরা বাংলার রাজস্ব সম্পর্কে অভিজ্ঞ নয়।
👉ফলাফল
দ্বৈতশাসন ব্যবস্থা বাংলাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয় ও বাঙালির জীবনকে দুর্বিষহ করে তােলে।
(১) কােম্পানি একচেটিয়াভাবে বিনাশুল্পে বাণিজ্য কায়েম করায় দেশীয় শিল্প-বাণিজ্য ধ্বংস হয়।
(২) অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের লােভে ইজারাদাররা কৃষকদের ওপর অত্যন্ত চড়া হারে কর নির্ধারণ করে। যে কৃষকরা তা দিতে অক্ষম হয় তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়।
(৩) কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা স্বনামে ও বেনামে বিল অব এক্সচেঞ্জ, বাধ, সেতু ও রাস্তা নির্মাণ ইত্যাদির মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ টাকা মুনাফা লােটে
(৪) ভারতে কোম্পানির বাণিজ্যের জন্য ইংল্যান্ড থেকে অর্থ বরাদ্ধ বন্ধ করে দেওয়া হয়। বাংলা থেকে আদায় করা রাজস্বেই পণ্য ক্রয় করে কোম্পানি এই পণ্য বিক্রয়ের মুনাফা ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেয়।
(৫) দ্বৈতশাসনের কুফল রুপে সেসময় বাংলায় দেখা দেয় ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। এই মন্বন্তরে বাংলার এক-তৃতীয়াংশ লােক অনাহারে মারা যায়।
2.শ্রীরঙ্গপত্তনের সদ্ধি (১৭১২):
টিপু সুলতানার সমরিক বাহিনীকে শক্তশালি করার চেষ্টা করেন । তিনি কাবুল, ফ্রান্স, মরিশাস প্রভৃতি দেশের সঙ্গে গােপনে যােগাযােগ রাখেন। ব্রিটিশ সরকার এই খবর পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়। তাই ইঙ্গ ফরাসি দন্দের সময় ব্রিটিশ নিজামের কাছে যে শক্তি সঙ্ঘ গঠনের প্রস্তাব পাঠায়, তা থেকে মহিসুর কে বাদ রাখে। টিপু সুলতান এই খটনায় ভীষণ মর্মাহত হন এবং ক্ষুব্ধ হয়ে ব্রিটিশ আধিনস্ত রাজ্য ত্রিবাঙ্কুর আক্রমণ করেন। ফলে ১৭৯০ সালে শুরু হয় তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশুর যুদ্ধ। টিপু সুলতান নিজে দু বছর বিরের মতাে লড়াই চালিয়ে যান। অবশেষে ১৭৯২ সালে গভর্নর কর্নওয়ালিস ও টিপু সুলতানের মধ্যে শ্রীরঙ্গপত্তনের সদ্ধি স্বাক্ষরিত হয়।
👉সন্ধির শর্তসমূহ
শ্রীরঙ্গপত্তমের সদ্ধির মাধ্যমে তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের অবসান ঘটে। সন্ধির ফলে মহীশুর রাজ্যের অর্ধাংশ টিপুর হস্তচ্যুত হয়। এই চুক্তি অনুয়ায়ী, (১) মারাঠারা ওয়ধা থেকে কৃষ্ণা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল লাভ করে (২) গুটি ও ফুদাপ্পা-সহ পেনার নদী থেকে কৃষ্ণা নদী পর্যন্ত অঞ্চল নিজাম পায়
3.অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি (১৭৯৮):
👉পটভূমি
ভারতের গভর্নর জেনারেলপে লর্ড ওয়েলেসলি ৭ বছরের শাসনকালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে যেসব পদক্ষেপগ্রহণ করেছিলেন সেগুলির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য ছিল অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি। নগ্ন সাম্রাজ্যবাদের নিলজ্জ নিদর্শন ছিল এই নীতিটি।
👉 শর্তাবলি
(১) অধীনতামুলক মিত্ৰতা নীতিতে আবদ্ধ দেশীয় রাজ্যগুলি কোম্পানির অনুমতি না নিয়ে অন্য কোনাে রাজ্যের সঙ্গে চুক্তি বা মিত্রতায় আবদ্ধ হতে পারবে না। (২) এই মিত্ৰতা নীতিতে আবদ্ধ দেশীয় রাজ্যগুলিকে সম্পূর্ণ নিজেদের খরচে এক প্রিটিশ | রেসিডেন্ট বা প্রতিনিধিসহ এল ব্রিটিশ সৈন্য মােতায়েন রাখতে হবে। (৩) সেনাবাহিনীর খরচ চালানাের জন্য বৃহৎ রাজ্যগুলি নিজেদের রাজ্যের একাংশ কোম্পানিকে ছেড়ে দেবে। ছােটো রাজ্যগুলি তাদের রাজ্যের একাংশ ছেড়ে দেওয়ার
জন্য নগদ টাকা কর রুপে চােম্পানিকে দিতে বাধ্য থাকবে। (৪) মিত্ৰতাবদ্ধ রাজ্য টিকে কর্মচারী রুপে ইংরেজদেরই নিয়ােগ করতে হবে। (৫) অধীনতামুলক মিতা নীতিতে আবদ্ধ রাজ্যগুলিকে যদি তৃতীয় কোনাে পক্ষ আক্রমণ করে, তাহলে তাকে রক্ষা ভাবে লেম্পানি।
👉 প্রয়ােগ
লর্ড ওয়েলেসলি এই নীতির দ্বারা বেশ কিছু দেশীয় রাজ্যকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। এরকম কয়েকটি রাজ্য হল ১৭৯৯ সালের ২৫ অক্টোবর তাঞ্জর, ১৮০০ সালের মার্চ সুরাট, ১৮০০ সালের অক্টোবরে হায়দরাবাদের নিজাম, ১৮০১ সালের ২৫ জুলাই কর্ণাটক। তিনি একে একে অযােধ্যার নবাব, পেশােয়া দ্বিতীয় বাজিরাওকে এই চুক্তিতে আবদ্ধ করেন। মাল,
উদয়পুর, জয়পুর, গায়কোয়াড়, যােধপুর, বুন্দেলখন্দ প্রভৃতি রাজ্যে অধীনতামুলক মিত্ৰতা নীতি প্রয়ােগ করেন।
👉গুরুত্ব :
(১) এই নীতিতে দেশীয় রাজ্যগুলিতে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা চরমে পৌঁছে। (২) দেশীয় রাজাদের অর্থে ইংরেজরা এক বিশাল সেনাবাহিনী মােতায়েন রাখার সুযােগ পেলে এদেশে কোম্পানির নিরাপত্তার জন্য সামরিক খরচ অনেকটাই কমে যায়।(৩) এই নীতিতে আবদ্ধ দেশীয় রাজ্যগুলির সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তােলার অজুহাতে মুলত কু-শাসন, প্রশাসনিক সংকট ও জটিলতা
সৃষ্টি করাই ছিল কোম্পানির লক্ষ্য। (৪) ওয়েলেসলি এই নীতির দ্বারা একদিকে দেশীয় রাজ্যগুলির মধ্যে ঐক্য ভেঙে দেন, অপরদিকে শর্ত অমান্যের অজুহাত এনে যে কোনাে সময় দেশীয় ও মিত্র রাজ্যগুলিকে গ্রাস করার পথ খােলা রাখেন। (৫) অধীনতামুলক মিত্রতা নীতিতে আবদ্ধ করে বহু দেশীয় রাজ্যের সঙ্গে ইংরেজরা সম্পর্ক গড়ে তােলার সুযােগ পায়। এই সুযােগে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে কোম্পানি তার ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটায়।
4. অমৃতসরের সন্ধি (১৮০৯)
👉পটভূমি
রণজিৎ সিং যখন একটার পর একটা শিখ মিশলকে বশ্যতা স্বীকার করিয়ে কর প্রদানে বাধ্য করার সময় ঝিন্দ ও পাতিয়ালার শিখ সর্দাররা ব্রিটিশ রেসিডেন্টের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। এসময়ে ব্রিটিশ সরকার ও রণজিৎ সিং পরস্পরের মধ্যে সাহায্যের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করে। চার্লস মেটকাফকে লাহােরে রণজিৎ সিংয়ের দরবারে দূতরূপে পাঠায়। মেটকাফ দুটি উদ্দেশ্য পূরণে সচেষ্ট হন। প্রথমত দক্ষিণের মিলগুলির ওপর রণজিতের আধিপত্য আটকানাে, দ্বিতীয়ত- রাশিয়ার জার
আলেকজান্ডার ও ফরাসি সম্রাট নেপােলিয়ন টিলজিটের সন্ধিতে আবদ্ধ হলে ফ্রান্স এর ভারত আক্রমণের সম্ভাবনা থাকায় ব্রিটিশ রণজিতের সাহায্য অনুভব করে। অবশেষে এইভাবে বড়লাট লর্ড মিন্টো তার দুত চার্লস মেটাফকে রণজিতের দরবারে পাঠিয়ে অমৃতসরের সন্ধিতে আবদ্ধ হন।
👉শর্তাবলি
অমৃতসরের সন্ধির শর্তাবলি
(১) রণজিৎ সিংয়ের রাজ্যের দক্ষিণ সীমান্তরূপে শতুদ্র নদীকে চিহ্নিত করা হয়।
(২) শতদ্রু নদীর পূর্বতীরে অবস্থিত মিশুলির ওপর থেকে রণজিৎ সিং তার দাবি প্রত্যাহার করে নেবেন।
(৩) নিরপত্তা রক্ষার তাগিতে রণজিৎ সিং উত্তর দিকে তার সেনাবাহিনী মােতায়েন রাখতে পারবেন বলা হয়।
(৪) শতদ্রু নদীর উত্তর দিকে কোম্পানি কোনাে হস্তক্ষেপ করবে না বলে কথা দেয়। (৫) চুক্তিতে আবদ্ধ দুপক্ষ স্থায়ী মৈত্রী বজায় রাখার জন্য একে অপরের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়।
👉গুরুত্ব
অমৃতসরের সন্ধি স্বাক্ষর রার ফলে রণজিৎ সিং এর অখিল শিখ রাজ্য গঠন চিরদিনের মতাে ধুলিসাৎ হয়ে যায়। ডঃ এ. কে. সিংহ বলেছেন- ‘এই সন্ধিতে রণজিৎ সিং অশ্ব এবং ব্রিটিশ সরকার অশ্বারােহীর ভূমিকা পালন করেছিল। প্রচণ্ড দূরদর্শী হয়েও | রণজিৎ সিং অমৃতসরের সন্ধি স্বাক্ষর করে চরম কুটনৈতিক ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছিলেন।
5.ভারতে সিভিল সার্ভিস প্রবর্তন
👉পটভূমি
পলাশি ও বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভের পর দেওয়ানি লাভ করলে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশে ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা কায়েম করে। প্রশাসনিক কাজ পরিচালনার জন্য সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার মাধ্যমে তাদের বহু উচ্চপদস্থ কর্চারী বা সিভিল সার্ভেন্ট নিয়ােগ করতে হয়।
👉লর্ড কর্ন- ওয়ালিসের প্রচেষ্টা –
ভারতে সিভিল সার্ভিসেস প্রকৃত প্রবর্তত ছিলেন লর্ড কর্নওয়ালিস। ১৭৮৬ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস গভর্নর জেনারেল রূপে ভারতে এসে কোম্পানির প্রশাসনিক কাজের মানকে উন্নত ও দ্রুতগামি করার লক্ষ্যে সিভিল সার্ভিসকে ঢেলে সাজানাের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি যে সব পদক্ষেপ নেন সেগুলি হল-
(১) প্রথমেই কোম্পানির বাণিজ্য দপ্তর ও রাজস্ব দপ্তর আলাদা করে দেন।
(2) রাজস্ব বিভাগের কর্মচারীদেরও প্রশাসনিক কাজে দক্ষ করে তােলার জন্য প্রশিক্ষণ শুরু করেন।
(৩) প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা যাতে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন চালাতে পারে তার জন্য বেতনের হার বাড়ানাে হয়। ইউরােপীয়দের বেতন গড়ে ৩০০-৪০০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানাে হয়।
(৪) ভারতীয়দের উচ্চ কোরি পদে নিয়ােগ নিষিদ্ধ করে দেন। নিয়ম হয়, বছরে ৫০০ পাউন্ডের বেশি বেতন পাবে এরকম কোনাে পদে ভারতীয়দের নিয়ােগ হবে না।
(৫) কর্মচারীদের দুর্নীতি বন্ধে ব্যক্তিগত ব্যবসা, উপটৌকন, উৎকোচ গ্রহণ নিষিদ্ধ করেন।
👉সিভিল সার্ভিস আন্দোলন
লর্ড লিটন ১৮৭৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার্থীদের বয়স ২১ থেকে কমিয়ে ১৯ করলে সারা দেশ জুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ভারতসভা এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আন্দোলন গড়ে তােলে। দাবি জানানাে হয়- (১) ভারতে ও ইংল্যান্ডে এখন থেকে একসঙ্গে পরীক্ষা নিতে হবে। (২) এই পরীক্ষার উধর্বতন বয়স সীমা ২২ বছর রতে হবে। যদিও সে সময়কার ‘ ভারতের বড়ড়লাট ল্যান্সডাউন তা মানতে চাননি।
6.ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট (১৮৭৮)
👉ভূমিকা
জনমত গঠনের ক্ষেত্রে এক শক্তিশালী মাধ্যম হল সংবাদ পত্র । কোনাে একটি দেশের সংবাদপত্র সেই দেশের জাতীয় জীবনের দর্পণস্বরূপ। ব্রিটিশ শাসন কালে দেশীয় ‘ভায্যয় সবেদপত্রগুলি ব্রিটিশ বিরধি সমালোচকের ভূমিকা পালন করেছিল। ১৮৭৮সালের ১৪ মার্চ দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্র গুলি ভারাবাসীর কণ্ঠরধের জন্য লর্ড লিটন জারি করেন দেশীয়ভাষায় সর্বোদপত্র আইন বা ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট ।
👉স্বাধীনতা আন্দোলন পূর্বে সংবাদপত্রের ভূমিকা
মহাবিদ্রোহের পর থেকে ১৮৭০ সাল পর্যন্ত বাংলা ভাষায় মােট ৮৭টি পত্র পত্রিকা প্রকাশিত হয়। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এর সম্পাদনায় হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকা টি মহাবিদ্রোহ বা নীল বিদ্রোহের সময় তীব্র ব্রিটিশ ভূমিকা পালন করেন। এছাড়াও অন্য যেসবপত্রিকাগুলি ব্রিটিশ বিরােধ ভূমিকা পালন করেছিল তার মধ্যে অন্যতম কয়েকটি হল- ঈশ্বর গুপ্তের সম্পদিনায় সংবাদ প্রভাকর, কেশবচন্দ্র সেনের সম্পাদনায় ইন্ডিয়ান মিরর, পত্রিকা, সুরেন্দ্রনাথ বন্যোপাধ্যায় সম্পাদিত দি বেঙ্গলি, শিশিরকুমার ঘোষ সম্পাদিত অমৃতবাজার, কিশােরীচাদ মিত্র সম্পাদিত ইন্ডিয়ান ফিল্ড।
👉সংবাদপত্রের পত্র নিয়ন্ত্রণ আইনের
লর্ড লিটন দেশীয় ভাষায় সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ আইন পাস করালে, তার বিভিন্ন ধারায় বলা হয়-
(১) সংবাদপত্রের সম্পাদক ও মুদ্রাকর এমন কিছু সংবাদ ছাপবেন না যাতে পাঠক সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করে।
(২) সংবাদপত্রে এমন কিছু ছাপা যাবেনা যে সংবাদ গুলি ব্রিটিশ ও ভারতবাসীর মধ্যে জাতি গত ব্দিদেশকে আরাে বাড়িয়ে তুলবে।
(৩) কোনাে দেশীয় সংবাদপত্র এই সবনিয়মগুলি অমান্য করলে সংশ্নিষ্ট সংবাদপত্রের অর্থ এবং প্রয়ােজনে মুদ্রাযন্ত সরকার বাজেয়াপ্ত কারতে পারবে।
(৪) সংবাদপত্রের সম্পাদক ও মুদ্রা কর কে উপরােক্ত দুটি নিয়ম মেনে সংবাদ ছাপবেন এই লক্ষে জামিন ও অঙ্গীকার পত্রে স্বাক্ষর করতে হবে।
👉ফলাফল
ইংরেজি সংবাদপত্রগুলিকে এই আইনের আওতার বাইরে রেখে শুধুমাত্র দেশীয় ভাবার সংবাদপত্রের ওপর এদেশের ব্রিটিশ সরকার এ আইন কাজ করতে চাওয়ায় সমগ্র দেশ ক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে। কলকাতার টাউন হলে রেভারেন্ট কৃষ্ণমােহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এমনকী ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টেও বিরােধীপক্ষ তীর প্রতিবাদের সুরে এই আইন প্রত্যাহারের দাবি জানায়।
7. জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা (১৮৮৫)
👉প্রতিষ্ঠা
১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় রাজনীতিতে সতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা হয়। জাতীয় কংগ্রেস দলটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে ভারতবাসীর স্বাধীনতার আকাকা একে ঘিরেই আবর্তিত হয়। স্বাধীনতা লাভের পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী বেশ কিছু সময়কাল ধরে জাতীয় কংগ্রেসই ছিল ভারতবাসীর প্রথম জাতীয়তাবাদী প্রতিষ্ঠান। স্বাধীনতার পূর্ব মহুত্ত পর্যন্ত এই দলটির উদ্দেশ্য ছিল তারতবাসীর রাজনৈতিক মুক্তি।
👉উদ্দেশ্য
১৮৮৫ সালে ২৮ ডিসেম্বর বােম্বাইয়ের গােলদাস তেজপাল সংস্কৃত কলেজে জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে যে চারটি মুল উদ্দেশ্যের কথা ঘােষণা করেছিলেন তা হল- (১)ভাষা ও ধর্ম বৈচিত্র্যে ভরা ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের দেশপ্রেমীদের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধুত্ব ও একাত্মতা গড়ে তােলা,
(২) সম্প্রীতির দ্বারা জাতি, ধর্ম, প্রাদেশিকতার তুচ্ছ সংকীর্ণতা দূর করে জাতীয় সংহতির পথ প্রশস্ত করা,
(৩) ভারতের রাজনৈতিক অগ্রগতির জন্য ভবিষ্যৎ কর্মসূচি গ্রহণ রা।
(৪) শিক্ষিতদের সুচিন্তিত মতামত গ্রহণ করে সামাজিক ও অন্যান্য সমস্যা সমাধানের উপায় নির্ণয় করা
👉হিউমের উদ্দেশ্য
(১) ব্রিটিশ শাসনের প্রতি ভারতবাসীর মনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ যাতে গণবিস্কোরণের রুপ না নিতে পারে, তার প্রতিরােধকরূপে ভারতীয়দের নেতৃত্বেই একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার বিশেষ প্রয়ােজন।
(২) ভারতবাসীর আশা-আকাঙ্খাগুলি যাতে সাংবিধানিক পদ্ধতি মেনে রূপায়িত হতে পারে তার জন্য কেটি প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন।
(৩) শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়কে রাজনৈতিক আন্দোলনগুলির সামনের সারিতে নিয়ে এসে এক শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে আলােচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে এক সর্বভারতীয় দল প্রতিষ্ঠার দরকার।
👉লর্ড ডাফরিনের উদ্দেশ্য
(১) এক সর্বভারতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠনের মাধ্যমে ভারতবাসীর যাবতীয় সমস্যাগুলি সরকারের গােচরে আনা।
(২) ব্রিটিশ শাসনের প্রতি অনুগতদের ব্রিটিশ বিরােধীদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া।
8.বয়কট ও স্বদেশি আন্দোলন (১৯০৫)
👉বয়কট ও স্বদেশির অর্থ
“বয়কট’ ও ‘স্বদেশি ছিল বঙ্গভঙ্গ-বিরােধী আন্দেলনের দুটি পৃথক ধারা। ‘বয়কট’ শব্দটির অর্থ ‘বর্জন’। কিন্তু বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে যে বয়কট-এর সূচনা হয় তার উদ্দেশ্য হল “বিলিতি পূণ্য বর্জন’। স্বদেশি কথাটির অর্থ হল নিজ জমিতে জাত। ব্যাপক অর্থে স্বদেশি বলতে বোঝায় নিজের দেশে উৎপন্ন দ্রব্য ব্যবহারের পাশাপাশি জাতীয় শিক্ষা গ্রহণের সংকল্প এবং দেশপ্রেমােদ্দীপক সংগীত ও সাহিত্য সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে জাতীয়তাবােধ উদ্দীপিত করা।
👉স্বরূপ
১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত কার্যকরী করার দিন হিসেবে নির্ধারিত হলে পূর্ণ উদ্যমে সারা বাংলায় বিলিতি পণ্য বর্জন বা বয়কট আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। এই আন্দোলনে স্কুল, কলেজের ছাত্রসম্প্রদায়ও ব্যাপকভাবে যােগদান করে। দলবদ্ধভাবে তারা দোকান-বাজারে ‘পিকেটিং’ শুরু করে। বয়কট আন্দোলন সমাজের সমস্ত শ্রেণির মধ্যে অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল। বহু জায়গায় মুচিরা বিদেশি সুতাে মেরামত না করার প্রতিজ্ঞা করে এবং ধােপারা বিলিতি কাপড় ধবে না বলে সংকল্প গ্রহণ করে। এমন বিলিতি জিনিস বিক্রি ও ব্যবহারকারীকে একঘরে করে রাখারও বহু ঘটনা ঘটতে থাকে।
👉উদ্দেশ্য
(১) ইংরেজদের বাণিজ্যিক স্বার্থের ওপর আঘাত হেনে ব্রিটিশ সরগর ও ব্রিটিশ জনমতের ওপর চাপ সৃষ্টি করে বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য করাই ছিল এই আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য।
(২) স্বদেশি শিল্পের বিকাশের জন্য বিলিতি পণ্য বর্জনেরও প্রয়ােজন ছিল।
9.গদর পার্টি (১৯১৩)
১৯১৩ সালে মােহন সিং ভাকনার সাহায্য নিয়ে লালা হরদয়াল আমেরির সানফ্রান্সিসকো শহরে গদর পার্টি গঠন করেন। শিখ, খ্রিস্টান, মুসলিমসহ প্রায় ১৫,০০০ প্রবাসী ভারতীয় এই দলের সদস্যপদ গ্রহণ করেন। প্রথম সভাপতি ছিলেন মােহন সিং ভাবনা,
সম্পাদক ছিলেন লালা হরদয়াল ।
👉আদর্শ
গদর’ শব্দের অর্থ বিপ্লব। ইংরেজি, হিন্দি, ও গুজরাতি ও উর্দু ভাষায় এই পত্রিকাটি বিপ্লবের আদর্শ প্রচার করত।
👉সশস্ত্র অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা
গদির পাটির সদস্যরা বিশ্বযুদ্ধের সুযােগে ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রাম চলিয়ে ইংরেজ শাসনের অবসানের সংকল্প গ্রহণ করে। এই উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত ভারতীয় সেনাদের স্বাধীনতার আদর্শে উদ্বুদ্ধ করতে ও ভারতীয় বিপ্লব দের সঙ্গে যােগাযােগ করে ভারতে একটি সশস্ত্র অত্যুথান ঘটাতে ১৯১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা থেকে দলে দলে ‘ভারতে ফিরতে থাকেন। ১৯১৫ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি রিসবিহারী বসু এদেরই সমর্থন এ উত্তর ভারতে সশস্ত্র অভুথ্যানের কর্মসূচি নেন। কিন্তু ক্রিপাল সিং নামে এক ভারতীয় সৈন্যের বিশ্বাসঘাতকতায় শেষ পর্যন্ত সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
👉 গদর পার্টির নিষিদ্ধকরণ
কানাডা, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন,জাপন, থাইল্যান্ড সহ বিশাল জাইগা সুড়ে গদর দলের সদস্যরা তাদের কার্যকলাপ চালিয়ে যাওয়ায় মার্কিন সরকার ব্রিটেনের চাপে হরদয়াল কে নৈরাজ্য বাদি আখ্যা দেয় ও তার বিরুদ্ধে মামলা শুরু করে। লালা হরদয়াল আমেরিকা ছেড়ে সুইৎজারল্যান্ড চলে আসেন। ১৯১৪ সালে গদির পাটির বিরুদ্ধে শুরু হয় হিন্দু ষড়যন্ত্র মামলা,অবশেষে গদর পাটিকে নিষিদ্ধ ঘােষণা হয়।
10.কগ্রেসের লাহাের অধিবেশন (১৯২৯)
👉সূচনা
১৯২৯সালের ২৯ ডিসেম্বর লাহােরে কংগ্রেসের অধিবেশন বসে। এই অধিবেশনে তরুণ নেতা জওহরলালের সভাপতিত্বে পূর্ণ স্বরাজের দাবি গৃহীত হয়। সর্ব শ্রেণি ও সর্বস্তরের ভারতবাসী পূর্ণ স্বরাজ লাভের আকাঙ্খায় দুঃখ ও ত্যাগ স্বীকার করার শপথ গ্রহণ করে। ১৯২৯সালের ৩১ ডিসেম্বর মধ্যরাতেরাভী (ইরাবতী) নদীর তীরে সভাপতিরূপে জওহরলাল বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে স্বাধীনতার প্রতীক তেরঙ্গা পতাকা তােলেন। অধিবেশনে যােগদানকারী প্রায় ১৫,০০০ কংগ্রেস কর্মীর উপস্থিতিতে তিনি পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি জানান।
👉কর্মসূচি
এই অধিবেশনের দু-দিন পরে ২ জানুয়ারি কংগ্রেস কার্যনির্বাহী কমিটি এক বৈঠকের মাধ্যমে ঠিক করে সারা দেশ জুড়ে পূর্ণ
স্বাধীনতার আদর্শ প্রচার করা হবে। জওহরলাল নেহরু ও সুভাষচন্দ্র বসুর প্রচেষ্টায় গৃহীত হয় বামপন্থী আদর্শ।
👉 পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাবের কারণ
(১) মহাত্মা গান্ধী এটা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বুঝেছিলেন যে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি ছাড়া ভারতবাসীকে আর শান্ত রাখা যাবে না।
(২) নেহরু রিপাের্ট অনুযায়ী ব্রিটিশ সরকার এক বছর সময় পেয়েছিল, কিন্তু তা অতিক্রান্ত হওয়ায় পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব কার্যকর করার জন্য ভারতে আন্দোলন শুরু হয়।
(৩) নেহরু রিপাের্টকে ব্রিটিশ সরকার অমান্য করায় জাতীয় শীর্ষ নেতৃবৃন্দ অপমানিত বােধ করেন।
👉স্বাধীনতা দিবস পালন
জাতীয় কংগ্রেস ঠিক করে যে যতদিন না ভারত স্বাধীন হচ্ছে ততদিন প্রতি বছর ২৬ জানুয়ারি স্বাধীনতা দিবস পালিত হবে। সেই কর্মসূচি অনুযায়ী দেশের সব জায়গায় স্বাধীনতা দিবস পালনের উদ্যোগ শুরু হয়। পুলিশি নির্যাতনকে অমান্য করেই ভারতবাসী স্বাধীনতা দিবস পালন করবে বলে শপথ নেয়।
11.সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি (১৯৩২)
👉প্রবক্তা
১৯৩২ সালের ১৬ আগস্ট ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রামসে ম্যাকডােনাল্ড সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি ঘােষণা করেন।
👉মূল বক্তব্য
এই নীতির দ্বারা অনুন্নত হিন্দু সম্প্রদায়ের পাশাপাশি মুসলিম, শিখ, ভারতীয় খ্রিস্টান, অ্যাংলাে-ইন্ডিয়ান প্রভৃতি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে পৃথক নির্বাচনের অধিকার দেওয়া হয়। মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত আসন কেবলমাত্র মুসলমানরাই বা শিখদের সংরক্ষিত আসনে শিখাই ভােটদানের অধিকার পাবে। একই সঙ্গে অনুন্নত হিন্দুদের পৃথক জাতি হিসেবে ঘােষণা করে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরােধ সৃষ্টি করা হয়।
👉 উদ্দেশ্য
ভারতের জাতীয় আন্দোলনকে দুর্বল করে দেওয়াই ছিল এই নীতির প্রকৃত উদ্দেশ্য। জাতীয় আন্দোলনের ভিত্তি ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের ঐক্য ও আন্দোলনমুখীনতা। পিছিয়ে পড়া হিন্দুদের পৃথক জাতি হিসেবে ঘােষণা করে সরকার হিন্দু সাম্প্রদায়িক ঐক্যে ভাঙন ধরাতে চেষ্টা করে।
“আমাদের যদি কোন বানান ভুল হয়ে থাকে ক্ষমা করবেন, যদি কোথাও বানান ভুল আপনাদের মনে হয়ে থাকে , বা কোনো বাক্য ভুল মনে হয় তাহলে অবশ্যই কমেন্ট বক্সে সেটি জানাবেন” ।
ধন্যবাদ
Note: পিডিএফ খুব তাড়াতাড়ি আপডেট দেয়া হবে
এরকম নতুন নতুন ইতিহাসের স্টাডি মেটেরিয়ালস ও অনান্য নোটস পেতে আমাদের মেনুতে ইতিহাস (History) পেজে যান এবং সেখানে সূচিপত্র হিসেবে বিভিন্ন স্টাডি মেটেরিয়ালস সাজানো রয়েছে আপনার যেটি প্রয়োজন সেটিতে ক্লিক করুন